© সৌভিক বসু
১৯৭৮ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে, ছোট্ট আমি, সদ্য বর্ণপরিচয় থেকে অক্ষর জ্ঞান নিয়ে, বাইরের ঘরে ঘুর ঘুর করছি। টেবিলের উপর চকচকে একটা পাতলা বইয়ের দিকে নজর গেল। অন্যরকম দেখতে একটি মেয়ে, উপরে বইয়ের নাম... নিজে নিজে শুরু করলাম বানান করে পড়া। স-এ-কার, আ-কার, ভ, ই-কার, য়-এ-কার ... কখন জানিনা মা এসে পিছনে দাড়িয়েছে, দেখছে সোয়া দুই বছরের ছানা, নিজে নিজে বানান করে বই পড়ার চেষ্টা করছে।
মা আমাকে থামিয়ে বললো, কি পড়ছিস? আমি আবার শুরু করলাম - স-এ-কার, আ-কার... মা শুধরে দিলো "স-ও-কার" ... এবার ঠিক লাগলো পড়তে ... বানান করে পড়ে ফেললাম "সোভিয়েত নারী"...
সেই শুরু... আর ২-৩ মাসের মধ্যেই যুক্তাক্ষর শিখে
গেলাম।
বাবা বলে ফেলুদা পড়াও, মা বলে রূপকথার গল্প পড়াও, এক কাকু এসে ধরিয়ে দিয়ে গেলো Wonder World এবং অবাক পৃথিবী কমিকস ... মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাকের জগৎ আমার সামনে বাংলা এবং ইংলিশে খুলে গেলো... গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম।
হাতে এলো শুকতারা... প্রচ্ছদে কৌশিক কে পড়বে ? পরের পাতায় বাঁটুল আছে যে !!! আর ভিতরে অপেক্ষা করছে হাঁদা ভোদা??? তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে ? মাসে একবার মিকি ডোনাল্ড, একবার হাঁদা ভোদা ও বাঁটুল... মন ভরবে কি করে ??
বাবা হাতে তুলে দিলেন অমর চিত্র কথা। সেই কাকু নিয়ে এলেন মুখোশধারি, বেগুনি রঙের চাপা ড্রেস পড়া এক ঘোড়সওয়ার এবং একটি লম্বা টুপি পড়া এক জাদুকরের গল্প... এবং তাদের জন্যে আমাকে এক মাস অপেক্ষা করতে হলো না, তারা প্রত্যেক ১৪ দিনে আমার কাছে এসে হাজির হতে আরম্ভ করলো তাদের অভিযান নিয়ে।
৫ বছর বয়সে, আরো একটি ইংরেজি কমিকস এসে গেলো আমার হাতে ... কপালের উপর কোকড়ানো চুল এসে পড়েছে, মুখে স্মিত হাসি, আকাশী রঙের গা চাপা পোশাক, এবং প্যান্টের উপর লাল রঙের জাঙ্গিয়া, পিছনে লাল রঙের কাপড় উড়ছে...
প্রথম দর্শনেই প্রেম... You will believe a man can fly !!!! প্রতি সপ্তাহে ১-২ করে কমিকস আসছে, গোগ্রাসে গিলছি, আহঃ ... এই তো জীবন কালী দা!!!
৬ বছর বয়সে বাঁধানো কমিকসের বই নিয়ে প্রথমবার মেজমাশির বাড়িতে দু দিন থাকতে গেলাম।
মেসো আমার হাতে বাঁধানো বই দেখে অবাক হলো,আরো অবাক হলো যখন দেখলো আমি কি যত্ন করে পড়ছি, খুব খুশি হয়ে বললো - ওটা তো তোর পড়া বই, আবার পড়ছিস, ভালো লাগছে ?? বাচ্চা আমি বলে উঠি, আবার সামনের সপ্তাহে নতুন বই আসবে, সে গুলো পড়বো।
মেসো হাত ধরে আমাকে নিয়ে এলো ছাদে। এর আগেও ওই বাড়ির ছাদে এসেছি, কিন্তু ছাদের ঘরে কোনদিনও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেদিন ঢুকলাম ...
কোনও দেওয়াল খালি নেই.... যেদিকে দেখি, শুধু বই।
একটা দেওয়ালের দিকে চোখ গেল। দেখি আমার নিয়ে আসা বাঁধানো বইটার মতন অজস্র বই। মেসোর দিকে তাকালাম , দেখি উনি হালকা হাসছেন.... এগিয়ে গিয়ে একটা বই বার করলাম .... ও মা !!! এ তো বেতাল .... আরো একটা !!! এটাও বেতাল...
কমিকসের স্বর্গে প্রবেশ পেলাম। সেই শুরু.... পরের ১০ বছর শীতকালে ৫ দিন, গরমকালে ৫ দিন মাসির বাড়ি থাকা fixed হয়ে গেলো।
দিন যায়, সেই কাকার হাত দিয়ে লাল চুলো এক টিনএজারের সঙ্গে আলাপ হলো, তার সঙ্গে তার খাদ্যরসিক , লম্বা নাকের টুপিওয়ালা বন্ধু এবং তাদের জীবনের সঙ্গে পরিচয় হলো।
মাসতুতো দিদিকে airport থেকে আনতে গিয়ে , সেখানকার বইয়ের দোকানে গিয়ে ৮ টাকা দামের আর্চি ডাইজেস্ট তুলে নিয়েছিলাম ২৫ খানা। মাথায় গাট্টা মেরে ২৪ খানা সরিয়ে নিয়েছিলো আমার মাসী। ১৯৮৩ সালে ২০০ টাকার কমিকস কিনে দিলে, মাসীকে আমার মা খুন করে দিত !!!
সেদিন রাগের মাথায় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম , পৃথিবীর সব কমিকস আমার কাছে থাকবে !!!
উপর থেকে একজন সেদিন একটা ৭ বছরের বাচ্চার প্রতিজ্ঞা শুনতে পেয়েছিলেন। সেদিন যদি অন্য কিছু চাইতাম, ১০০ কোটি টাকা বা হলিউডের হিরো বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী , সেটাও হয়ে যেত !!!
আজ আমার কাছে ১,০০,০০০ এর বেশি ডিজিটাল কমিকস আছে, টিনটিন, Asterix, নারায়ণ দেবনাথ, সম্পূর্ণ ইন্দ্রজাল কমিকসের বাঁধানো সেট আছে... ১০০০- এর বেশি আর্চি, ডিসি, মার্ভেল হার্ড কপি আছে....কিন্তু সেই ৭ বছরের ছেলেটার হাতে সেগুলো তুলে দেওয়া হয়নি....
যাই হোক... দিন কেটে যাচ্ছে, বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো, কাকু বাবাকে পথে বসিয়ে,আমার হাতে নন্টে ফন্টে ধরিয়ে দিয়ে, দুষ্টু লোক হয়ে গেলো (ভ্যানিশ) । অবাক পৃথিবী প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলো, ডিসির ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি বন্ধ হয়ে গেলো... ইন্দ্রজালের দাম বেড়ে গেলো, আমার সাপ্লাই কমে গেলো। একমাত্র বছরে ২ বার মাসির বাড়ি গেলেই নতুন কমিকস পড়তে পারতাম... মাঝে, মাঝে কেউ যদি কোনো কমিকস উপহার দিতো, তবেই কিছু পড়া হতো। স্কুলের বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে পড়তাম...
১৬ বছর বয়সের পরে, লেখা পড়ার চাপ বেড়ে গেলো। ততদিনে ইন্দ্রজালও বন্ধ হয়ে গেলো, মাসির বাড়ি গিয়ে থাকা ঘুচে গেলো। ১৮ বছরে পড়ার জন্যে বঙ্গদেশ ছাড়লাম। ৬ মাস পরে বাড়ি ফিরে দেখি, উই আর ইদুরে আমার সব বই ধ্বংস করে দিয়েছে !!!!
কাকে দোষ দেবো?? বাবা জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন। মা আমার ১৬ বছর বয়সে, সংসার বাঁচানোর জন্যে চাকরি করতে ঢুকলেন ৪০ কিমি দূরে একটি অফিসে।
সংসার চালাতে গিয়ে বইয়ের দিকে আর কি করে নজর যাবে ??? পোকায় এবং ইদুরে কাটা বই গুলো হাতে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা বসে ছিলাম।
কলেজের ৪ বছর আমার সাথী ছিলো পুজোবার্ষিকী গুলো... শীতের ছুটিতে এসে নিয়ে যেতাম পত্রিকা গুলো। ২২ বছর বয়সে চাকরি নিয়ে বোম্বে গেলাম। লোকাল ট্রেনের স্টেশনে আবার দেখলাম আর্চি কমিকস.... প্রথম মাইনে ৫৫০০ টাকা পেয়ে , আগে বাড়িওয়ালা কে ১৭০০ টাকা দিলাম, ১০০০ টাকা মাকে পাঠিয়ে দিয়ে, ৪০ টাকা দিয়ে আবার আর্চি কিনলাম। পরের ৩.৫ বছর ধরে ৩০/৩৫ খানা আর্চি আমার কাছে ফিরে আসার পরে, আবার সব কিছু ফেলে, আমাকে বিলেত যেতে হলো কর্মসূত্রে... বইগুলো আবার কলকাতায় পাঠিয়ে দিলাম।
লিডস শহরে প্রথম দিন কাজ শুরু করে, লাঞ্চ করার জন্যে অফিসের নিচে একটা স্যান্ডউইচের দোকানে ঢুকতে যাওয়ার মুখেই দেখি, একটা দোকানে একজন চেনা মুখের ছবি.... সেই স্মিত হাসি, সেই কোকড়ানো চুল, সেই লাল জাঙ্গিয়া.... লাঞ্চ না করে ঢুকে গেলাম "Mid town Comics Shop" এ....
কমিকসের জন্যে স্পেশালিস্ট দোকান !? ভাবা যায়... সেদিনই কিনে ফেললাম Death of Superman এবং Amazing Spider-Man এর প্রথম ১০০টা সংখ্যার black and white reprint
পরের ২ বছরে যা কমিকস কিনেছিলাম, দেশে ফিরে আসার সময় ১৭০ পাউন্ড দিয়ে কুরিয়ার করে এনেছিলাম। দেশে ফিরে দেখি ডিসি আর মার্ভেল আবার নতুন করে প্রকাশিত হচ্ছে, এবং যথেষ্ট সস্তায় প্রকাশিত করছে গোথাম কমিকস।
২০০৫ এ আবার বিলেত গেলাম দুই মাসের জন্যে, এবং প্রথমবারের জন্যে পেলাম ডিজিটাল কমিকস।
ফ্যান্টাস্টিক ফোরের সম্পূর্ন ৪৫০ খানা কমিকস, মার্ভেল থেকেই পিডিএফ করে ডিভিডিতে বিক্রি করছিলো.... ব্যাস , আমায় আর পায় কে !!! সস্তায় পুষ্টিকর, ডিজিটাল কমিকস আমার হাতের মুঠোয় চলে এলো।
প্রথম প্রথম ল্যাপটপে পড়তাম, কিন্তু বসে বসে পড়তে ভালো লাগে না। শুয়ে পড়ে, ল্যাপটপটা বুকের উপর নিয়ে পড়তাম, কিন্তু স্ক্রিনটা চোখ থেকে অনেক দূরে, ভালো লাগতো না।
২০০৯ এ শুনলাম, অ্যাপল কোম্পানি একটা স্ক্রীন সর্বস্ব ল্যাপটপ বার করবে, নাম দেবে আইপ্যাড। ২০১০ এ বাজারে এলো আইপ্যাড ১, যা দাম করেছিলো, বুক কেপে উঠলো শুনে।
আবার উপর থেকে আমার দিকে একজন ফিরে তাকালেন, ২০১১ এ এলো আইপ্যাড ২, আর সেইবারই আমাদের অফিসে আমাদের একটা বোনাস পেলাম (সেই প্রথম, সেই শেষ) - একটা ১৬ জিবি আইপ্যাড এবং তার কভারের ব্যবস্থা হয়ে গেলো ।
শুধু ল্যাপটপ থেকে তার লাগিয়ে ঢোকানোর অপেক্ষা। আজ ১১ বছর হয়ে গেল, এখনও তার লাগাচ্ছি, ট্যাবলেটে ঢোকাচ্ছি আর পড়ছি। ... কালীদা !!! এই জীবনই তো চেয়েছি....
মেসোর অবর্তমানে মাসী সব কটা বাঁধানো কমিকস আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। মা রিটায়ার করেছেন, এখন আমার বইগুলোকে গুছিয়ে রাখছেন। বাবা জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে আগের মানুষটার একটা ছায়া হয়ে বেঁচে আছেন। আমি দেশেই প্রবাসী হয়ে ভাবছি, কি করে একটা ঘর বানিয়ে কলকাতা থেকে আমার বইগুলোকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
যা বই হারিয়েছিলাম, সব ফিরে পেয়েছি সুদে-আসলে। ট্যাবলেটে কমিকস পড়বার মজাটা নেওয়ার চেষ্টা করি। যা যা চেয়েছি, সব না হলেও অনেক কিছুই পেয়েছি, কিন্তু সেই ৭ বছরের ছেলেটার হাত থেকে যে ২৪ খানা বই নামিয়ে নেওয়া হয়েছিলো, সেগুলো আর সে পেলনা ....
No comments:
Post a Comment