@সৌভিক বসু
সৌম্য আর বৈশাখীর ২২ বছরের সুখের সংসার। মুম্বাই শহরতলির ৩ কামরার ফ্ল্যাটে থাকে।নিঃসন্তান দম্পতি, সৌম্যর বাবা ১৩ বছর আগে মারা গেছেন, সৌম্যর মা ৩ মাস কলকাতার আদি বাড়িতে থাকেন, ৩ মাস মুম্বাইতে থাকেন।
বিয়ের এক বছরের মাথায় বৈশাখী প্রেগন্যান্ট হয়, কিন্তু জানবার ৭ দিনের মাথায় ২ মাসের ভ্রুন মিসক্যারেজ হয়ে যায়।খুব আশা ছিল মেয়ে হবে, নামও ভেবে নিয়েছিল - ভালো নাম মল্লিকা, ডাক নাম মিষ্টি।
তারপর ধরা পরে দুজনেই থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার, সেই জন্যে আর সন্তানের চেষ্টা করে না।
আক্ষেপ
নেই, তবুও মাঝে মাঝেমনে হয় একটি মেয়ে থাকলে ভালো হতো।
ভরা বর্ষা, মা কোলকাতায় – রবিবার ভোর বেলায় সৌম্যর ঘুম ভেঙ্গে গেল – মাথায় গান বাজছে – সেদিনদেখা হয়েছিল … বেডরুম থেকে বেরিয়ে মুখ ধুতে গিয়ে সৌম্যর চোখ পড়লোগেস্ট রুমের দিকে , দরজা বন্ধ । রাত্রে গেস্ট রুমের দরজা খোলাই থাকে, মা যখন কোলকাতায় থাকে … দরজা ঠেলতে গিয়ে সৌম্য বুঝল যে ভিতর থেকে লাগানো।
জোরে জোরে ধাক্কা দিতে , ভিতর থেকে আওয়াজ আসে – কি হয়েছে ! একটু ঘুমোতেও দেবে না !
অল্প বয়সী একটি মেয়ের গলা, ঘুম থেকে সদ্য উঠলে যেমন লাগে, সৌম্য চেঁচিয়ে
ওঠে – কে , ভিতরে কে ! এখুনি দরজা খোলো !!আওয়াজ শুনে বৈশাখী এসে গেছে – দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বছর কুড়ির একটিমেয়ে – মুখের আদল একদম বৈশাখীর মতন, কিন্তু চোখ দুটো সৌম্যর মতন – কটা …আহত দৃষ্টিতে মেয়েটা তাকিয়ে থাকে সৌম্যর দিকে – কি হয়েছে বাবা, নাহয় কাল রাত্রে একটা মিথ্যে কথা বলেছি, তা বলে আমাকে চিনতে পারছো না ? এই তুমি তোমার মিষ্টি কে ভালোবাসো ?সৌম্য দু পা পিছিয়ে যায়, ততক্ষণে বৈশাখী শ্বাশুরিকে ফোন করে দিয়েছে– মা, আমাদের ঘরে একটা মেয়ে ঢুকে পড়েছে, সৌম্যকে বাবা বলছে , নাম বলছে মিষ্টি !
এবার মেয়েটা চেঁচিয়ে ওঠে – মা, তোমরা কি আরম্ভ করেছ ? তুমিও আমাকে চিনতে অস্বীকার করছো ?ফোনের ওপার থেকে সৌম্যর মা বলে ওঠেন – তোরা দুজনেই একটু বেশী পাগলামো করে ফেলছিস না ? একটা মাত্র মেয়ে তোদের , কি এমন মিথ্যা কথা বলেছে যে সকাল সকাল মেয়েকে চিনতে পারছিস না … ওর দাদু ঘুমোচ্ছে এখন, পরে জানলে তোদেরকেই বকুনি দেবে ! …
এর পরে সৌম্য বুঝতে পারে , তারিখটা ২২ জুলাই – ২১ বছর আগে যেদিন ওরা প্রথম জেনেছিল বৈশাখী মা হতে চলেছে…
সাইন্স ফিকশন গল্প এবং সিনেমা দেখার সুবাদে সৌম্য আর বৈশাখী বুঝতে পারে যে ওরা একটা Alternate Timeline-এ পৌঁছে গেছে … ঠিক যেন “The Man in the high castle” – যেখানে ওদের মেয়ে সঠিক সময়ে জন্ম নিয়েছে, বড়ো হয়েছে … সৌম্যর বাবা মারা যান নি … বাবা ও মা কোলকাতায় থাকেন, বছরে একবার করে ঘুরে যান …কি করে এমন হলো দুজনে কেউ বুঝতে পারলো না , কিন্তু যে মেয়েকে জন্মাবার আগেই হারিয়ে ফেলেছিল, তাকে এখন পেয়ে দুজনে মিলে আঁকড়ে ধরলো, তিনজনের মধ্যে কতো গল্প,কত হাসি, কত কান্না জমে ছিল, সব বেরিয়ে এলো …মেয়ে তো বাবা মার ন্যাওটা , বাবা মা বাড়ি থেকে বেরচ্ছে না, মেয়ে-ও বেরচ্ছে না … ৭ দিন ধরে একে অপরকে ছেড়ে কেউ নড়ল না।২০ বছরের সব জমে থাকা কথা বেরিয়ে আসতে থাকলো…
এই ভাবে ৭ দিন কেটে গেলো, পরের রবিবার সৌম্য ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুতে গিয়ে দেখে গেস্ট রুমের দরজা খোলা, দৌড়ে গিয়ে দেখে বিছানা পাট পাট করা, ঘরে একটা অল্পবয়সী মানুষ থাকার কোন চিহ্ন নেই … বৈশাখী অস্থির হয়ে সৌম্যর মা কে ফোন করলো – মিষ্টি বাড়িতে নেই !
যেটা ভয় করেছিল, সেটাই হলো – সৌম্যর মা বলে উঠলেন – তোরা দুজনে কি পাগল হয়ে গেছিস ? তোদের বাচ্ছা তো কবেই মিসক্যারেজ হয়ে গেছে …ওরা খেয়াল করলো – ২১ বছর আগে যে আসার ৭ দিন পরে ওদের ছেড়ে চলে গেছিলো,সেই মিষ্টি আবার ওদের জীবনে ৭ দিনের জন্যে এসে, ২১ বছরের জমানো ভালবাসা দিয়ে বাকি জীবনেরজন্যে দুঃখ ছেড়ে চলে গেছে …কোনো কসমিক দেবতা ওদের ইমোশন নিয়ে একটু খেলা করে গেলেন …একটা অল্টারনেট টাইমলাইনে ওরা জীবনের ৭ দিন কাটিয়ে এলো …সৌম্যর মাথায় ৭ দিন আগের গান বাজছে – সেদিন দেখা হয়েছিলো …
No comments:
Post a Comment