Tuesday, October 28, 2025

সেদিন দেখা হয়েছিল

@সৌভিক বসু

সৌম্য আর বৈশাখীর ২২ বছরের সুখের সংসার। মুম্বাই শহরতলির ৩ কামরার ফ্ল্যাটে থাকে।নিঃসন্তান দম্পতি, সৌম্যর বাবা ১৩ বছর আগে মারা গেছেন, সৌম্যর মা ৩ মাস কলকাতার আদি বাড়িতে থাকেন, ৩ মাস মুম্বাইতে থাকেন। 

বিয়ের এক বছরের মাথায় বৈশাখী প্রেগন্যান্ট হয়, কিন্তু জানবার ৭ দিনের মাথায় ২ মাসের ভ্রুন মিসক্যারেজ হয়ে যায়।খুব আশা ছিল মেয়ে হবে, নামও ভেবে নিয়েছিল - ভালো নাম মল্লিকা, ডাক নাম মিষ্টি।

তারপর ধরা পরে দুজনেই থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার, সেই জন্যে আর সন্তানের চেষ্টা করে না।

আক্ষেপ 

নেই, তবুও মাঝে মাঝেমনে হয় একটি মেয়ে থাকলে ভালো হতো।

ভরা বর্ষা, মা কোলকাতায় – রবিবার ভোর বেলায় সৌম্যর ঘুম ভেঙ্গে গেল – মাথায় গান বাজছে – সেদিনদেখা হয়েছিল … বেডরুম থেকে বেরিয়ে মুখ ধুতে গিয়ে সৌম্যর চোখ পড়লোগেস্ট রুমের দিকে , দরজা বন্ধ । রাত্রে গেস্ট রুমের দরজা খোলাই থাকে, মা যখন কোলকাতায় থাকে … দরজা ঠেলতে গিয়ে সৌম্য বুঝল যে ভিতর থেকে লাগানো।

জোরে জোরে ধাক্কা দিতে , ভিতর থেকে আওয়াজ আসে – কি হয়েছে ! একটু ঘুমোতেও দেবে না !

অল্প বয়সী একটি মেয়ের গলা, ঘুম থেকে সদ্য উঠলে যেমন লাগে, সৌম্য চেঁচিয়ে

ওঠে – কে , ভিতরে কে ! এখুনি দরজা খোলো !!আওয়াজ শুনে বৈশাখী এসে গেছে – দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বছর কুড়ির একটিমেয়ে – মুখের আদল একদম বৈশাখীর মতন, কিন্তু চোখ দুটো সৌম্যর মতন – কটা …আহত দৃষ্টিতে মেয়েটা তাকিয়ে থাকে সৌম্যর দিকে – কি হয়েছে বাবা, নাহয় কাল রাত্রে একটা মিথ্যে কথা বলেছি, তা বলে আমাকে চিনতে পারছো না ? এই তুমি তোমার মিষ্টি কে ভালোবাসো ?সৌম্য দু পা পিছিয়ে যায়, ততক্ষণে বৈশাখী শ্বাশুরিকে ফোন করে দিয়েছে– মা, আমাদের ঘরে একটা মেয়ে ঢুকে পড়েছে, সৌম্যকে বাবা বলছে , নাম বলছে মিষ্টি !

এবার মেয়েটা চেঁচিয়ে ওঠে – মা, তোমরা কি আরম্ভ করেছ ? তুমিও আমাকে চিনতে অস্বীকার করছো ?ফোনের ওপার থেকে সৌম্যর মা বলে ওঠেন – তোরা দুজনেই একটু বেশী পাগলামো করে ফেলছিস না ? একটা মাত্র মেয়ে তোদের , কি এমন মিথ্যা কথা বলেছে যে সকাল সকাল মেয়েকে চিনতে পারছিস না … ওর দাদু ঘুমোচ্ছে এখন, পরে জানলে তোদেরকেই বকুনি দেবে ! … 

এর পরে সৌম্য বুঝতে পারে , তারিখটা ২২ জুলাই – ২১ বছর আগে যেদিন ওরা প্রথম জেনেছিল বৈশাখী মা হতে চলেছে…

সাইন্স ফিকশন গল্প এবং সিনেমা দেখার সুবাদে সৌম্য আর বৈশাখী বুঝতে পারে যে ওরা একটা Alternate Timeline-এ পৌঁছে গেছে … ঠিক যেন “The Man in the high castle” – যেখানে ওদের মেয়ে সঠিক সময়ে জন্ম নিয়েছে, বড়ো হয়েছে … সৌম্যর বাবা মারা যান নি … বাবা ও মা কোলকাতায় থাকেন, বছরে একবার করে ঘুরে যান …কি করে এমন হলো দুজনে কেউ বুঝতে পারলো না , কিন্তু যে মেয়েকে জন্মাবার আগেই হারিয়ে ফেলেছিল, তাকে এখন পেয়ে দুজনে মিলে আঁকড়ে ধরলো, তিনজনের মধ্যে কতো গল্প,কত হাসি, কত কান্না জমে ছিল, সব বেরিয়ে এলো …মেয়ে তো বাবা মার ন্যাওটা , বাবা মা বাড়ি থেকে বেরচ্ছে না, মেয়ে-ও বেরচ্ছে না … ৭ দিন ধরে একে অপরকে ছেড়ে কেউ নড়ল না।২০ বছরের সব জমে থাকা কথা বেরিয়ে আসতে থাকলো…

এই ভাবে ৭ দিন কেটে গেলো, পরের রবিবার সৌম্য ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুতে গিয়ে দেখে গেস্ট রুমের দরজা খোলা, দৌড়ে গিয়ে দেখে বিছানা পাট পাট করা, ঘরে একটা অল্পবয়সী মানুষ থাকার কোন চিহ্ন নেই … বৈশাখী অস্থির হয়ে সৌম্যর মা কে ফোন করলো – মিষ্টি বাড়িতে নেই !

যেটা ভয় করেছিল, সেটাই হলো – সৌম্যর মা বলে উঠলেন – তোরা দুজনে কি পাগল হয়ে গেছিস ? তোদের বাচ্ছা তো কবেই মিসক্যারেজ হয়ে গেছে …ওরা খেয়াল করলো – ২১ বছর আগে যে আসার ৭ দিন পরে ওদের ছেড়ে চলে গেছিলো,সেই মিষ্টি আবার ওদের জীবনে ৭ দিনের জন্যে এসে, ২১ বছরের জমানো ভালবাসা দিয়ে বাকি জীবনেরজন্যে দুঃখ ছেড়ে চলে গেছে …কোনো কসমিক দেবতা ওদের ইমোশন নিয়ে একটু খেলা করে গেলেন …একটা অল্টারনেট টাইমলাইনে ওরা জীবনের ৭ দিন কাটিয়ে এলো …সৌম্যর মাথায় ৭ দিন আগের গান বাজছে – সেদিন দেখা হয়েছিলো …

অথ বোম্বাই প্রেম কথা

©সৌভিক বসু 

আমি গত 22 বছর ধরে বিবাহিত, সেই জন্য আগেই বলে দিচ্ছি, এই ঘটনাগুলির সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত নই (কেউ জবরদস্তি জড়াবার চেষ্টা করলে সাইডে আসুন - আলাদা করে কথা বলছি), কিন্তু আমার পরিচিত 6 জন ভুক্তভোগী ... একটু আগে জানলাম আরো দুজনের সাথে গত পাঁচ বছরের মধ্যেই হয়েছে।

যাকগে, ভ্যানতাড়া না করে এগোনো যাক...

গত শতাব্দীর নয়ের দশকের ঘটনা। 

মায়ানগরী মুম্বাই, কেউ কেউ বলে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী। 

অনেক মানুষের মতন আমিও মুম্বাইতে পাড়ি দিয়েছিলাম চাকরি সূত্রে। প্রথম এক মাস এক আত্মীয়র বাড়ীতে থাকার পর প্রথম মাইনে পেয়ে একটা PG তে চলে যাই।

চাকরি সূত্রে অফিসে, চার্টার্ড বাসে, কমন বন্ধুদের মাধ্যমে আমার প্রচুর মানুষের সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়েছিল, কাল প্রবাহে আজ ২৫ বছর পর তাদের মধ্যে মাত্র ২-৩ জনের সাথে যোগাযোগ রয়ে গেছে।

সন্ধ্যার পরে বা ছুটির দিনে, তাদের সঙ্গে আড্ডার সময় এই ঘটনা গুলি শুনতাম।

একটুও বাড়িয়ে বলছি না, ঠিক এই পরম্পরায় ঘটনা গুলি ঘটেছিলো 1995 থেকে 1999 সালের মধ্যে।

কসমোপলিটান হলেও মুম্বাই শহরের ৭০% মানুষ মহারাষ্ট্রের মূল নিবাসী।

সুতরাং অফিসে, বাসে, ট্রেনে যেদিকে দেখবেন ৭০% মানুষ মারাঠি।

এরা মানুষ হিসাবে বেশ ভালো, বিপদে পড়লে সাহায্য-টাহায্য করে দেবেন। দোষ একটাই, এদের খাবার আমাদের বাঙালিদের মুখে রোচে না।

যাই হোক ... ধরুন আপনি অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন, শহরে আপনি বিশেষ কাউকে চেনেন না। আপনি একজন অবিবাহিত পুরুষ, চাকরি করছেন, কোনো রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে জড়িত নেই.... বিধাতার নিয়ম অনুযায়ী আপনি অফিসের কলিগ বা বাসে/ট্রেনে কোনো সহ-যাত্রিনী বা আপনার বসবাসের এলাকার কোনো সুন্দরীর প্রতি আকৃষ্ট হলেন ... একদিন চোখে চোখ পড়ল, আপনার মুখে একটা ক্যাবলা মার্কা হাসি চলে এলো... ভাগ্য ভালো থাকলে ওদিক থেকেও একটা হালকা হাসি, একটা লাজুক চাহনি পেয়ে গেলেন।

এক অফিস বা এক ডিপার্টমেন্টে থাকলে আলাপ তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, সহ-যাত্রিনী বা এলাকার কেউ হলে আলাপ হতে একটু সময় লাগবে।

আপনি মানুষ ভালো হলে, আলাপ হতে বাধ্য... আলাপ হলো, গল্প হলো, এবার আপনারা একসঙ্গে অফিসের পর দেখা করলেন। প্রথম ডেট যদি সাফল্য পায়, তারপর আপনারা আবার ডেট করলেন...

এবার ভালো করে পড়ুন :

আপনার পছন্দের নারী যদি মারাঠি হন.... 

মারাঠি মেয়েরা তৃতীয় ডেট করার ৩ দিনের মাথায় আপনাকে বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাইবে মার সাথে দেখা করাবার জন্য (ghari sala na... Nantar aai ragvel) অর্থাৎ "বাড়ি চল , নাহলে মা রাগ করবে)।

আপনি ভালো ছেলে, আপনি একদিন অফিস থেকে হাফ ছুটি নিয়ে যাবেন তাঁর বাড়ীতে ...

মা যদি আপনাকে পছন্দ করে নেয়, তারপর তাঁর ভাই আপনাকে নিয়ে যাবে নিজের বন্ধুদের সাথে আলাপ করাতে... Hey porga majha Bahin chi Chhava aahe (এই ছেলেটা আমার বোনের বয়ফ্রেণ্ড)।

ক্যারম বা ক্রিকেট খেলতে হবে বিকেলবেলায়।


সন্ধ্যে বেলায় বাবা বাড়ি ফিরলে আরো এক রাউন্ড ইন্টারভিউ... পাস করলেই aaj raati jhevan nantar ghari zaanar (আজ রাত্রে খেয়ে বাড়ি যেও)। আমরস দিয়ে বাজরার রুটি খেয়ে শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরবেন।


পরের দিন থেকে অফিসিয়ালি ঘোরার পারমিশন পাবেন ... তবে সন্ধ্যে আটটার সময় mala ghari zanaar, nantar aai ragvel (আবার!!!) শুনতে হবে।


পরের রবিবার দুপুরে খেতে ডাকবে , তখন Kaka (কাকা/মামা), Kaku(মাসি) এরাও থাকবে ...

কুচি কুচি সাইজের মুরগির ট্যালট্যালে ঝোল দিয়ে ফ্যানমরা ভাত খেতে খেতে (যদি না শ্রাবণ মাস বা অমাবস্যা বা পূর্ণিমা বা সংক্রান্তি হয়, তখন ভিন্ডি মসলা বা বেগুন ভর্তা দিয়ে আটার লুচি খেতে খেতে) শুনতে পাবেন ...

Didi, ha Porga changla ahe (দিদি, এই ছেলেটা ভালো) অথবা "Kay bhau, ha kasa porga ahes ?" (আরে দাদা, এ কেমন ছেলে এনেছো ?)।

নেগেটিভ ফিডব্যাক এলে, পরের দিন থেকে you will be ghosted !!! বাসে/ট্রেনে/অফিসে আপনাকে পাত্তা দেওয়া হবে না….


Move on bro !!!


তবে পজিটিভ ফিডব্যাক এলে, আরো এক সপ্তাহ ঘুরতে পারবেন, কিন্তু রাত 9টার কারফিউ থাকবে।


পরের শুক্রবার (যদি না শ্রাবণ মাস বা অমাবস্যা বা পূর্ণিমা বা সংক্রান্তি হয়) মেয়ের বাবা আপনাকে বাড়ীতে মদ্যপান করতে ডাকবেন , পমফ্রেট মাছ ভাজা আর পাঁপড় দিয়ে 3 পেগ ব্যাগ-পাইপার বা রয়েল চ্যালেঞ্জের পর - tumcha aai vadil kadi aanar ? Lagnachi tarikh charcha karnar ( এটাও অনুবাদ করতে হবে ?)... তবে শুনুন - তোমার মা বাবা কবে আসবেন ? বিয়ের দিন ঠিক করতে হবে তো....

নয়ের দশকের ৩ জন এবং এখনকার দুজনের বিয়ে সেই মেয়ের সাথেই ৪/৫ মাসের মধ্যে হয়ে গেছিল।

বাকি ৩ জন বাস/ট্রেন/অফিস পাল্টে নিয়েছিল ...

মাইরি বলছি , এক্কেবারে সত্যি কথা।

😂😂😂😂

আমি ও কমিকস, নাকি কমিকস ও আমি ?

© সৌভিক বসু

১৯৭৮ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে, ছোট্ট আমি, সদ্য বর্ণপরিচয় থেকে অক্ষর জ্ঞান নিয়ে, বাইরের ঘরে ঘুর ঘুর করছি। টেবিলের উপর চকচকে একটা পাতলা বইয়ের দিকে নজর গেল। অন্যরকম দেখতে একটি মেয়ে, উপরে বইয়ের নাম... নিজে নিজে শুরু করলাম বানান করে পড়া। স-এ-কার, আ-কার, ভ, ই-কার, য়-এ-কার ... কখন জানিনা মা এসে পিছনে দাড়িয়েছে, দেখছে সোয়া দুই বছরের ছানা, নিজে নিজে বানান করে বই পড়ার চেষ্টা করছে। 

মা আমাকে থামিয়ে বললো, কি পড়ছিস? আমি আবার শুরু করলাম - স-এ-কার, আ-কার... মা শুধরে দিলো "স-ও-কার" ... এবার ঠিক লাগলো পড়তে ... বানান করে পড়ে ফেললাম "সোভিয়েত নারী"... 

সেই শুরু... আর ২-৩ মাসের মধ্যেই যুক্তাক্ষর শিখে 

 গেলাম।  

বাবা বলে ফেলুদা পড়াও, মা বলে রূপকথার গল্প পড়াও, এক কাকু এসে ধরিয়ে দিয়ে গেলো Wonder World এবং অবাক পৃথিবী কমিকস ... মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাকের জগৎ আমার সামনে বাংলা এবং ইংলিশে খুলে গেলো... গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম। 

হাতে এলো শুকতারা... প্রচ্ছদে কৌশিক কে পড়বে ? পরের পাতায় বাঁটুল আছে যে !!! আর ভিতরে অপেক্ষা করছে হাঁদা ভোদা??? তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে ? মাসে একবার মিকি ডোনাল্ড, একবার হাঁদা ভোদা ও বাঁটুল... মন ভরবে কি করে ?? 

বাবা হাতে তুলে দিলেন অমর চিত্র কথা। সেই কাকু নিয়ে এলেন মুখোশধারি, বেগুনি রঙের চাপা ড্রেস পড়া এক ঘোড়সওয়ার এবং একটি লম্বা টুপি পড়া এক জাদুকরের গল্প... এবং তাদের জন্যে আমাকে এক মাস অপেক্ষা করতে হলো না, তারা প্রত্যেক ১৪ দিনে আমার কাছে এসে হাজির হতে আরম্ভ করলো তাদের অভিযান নিয়ে। 

৫ বছর বয়সে, আরো একটি ইংরেজি কমিকস এসে গেলো আমার হাতে ... কপালের উপর কোকড়ানো চুল এসে পড়েছে, মুখে স্মিত হাসি, আকাশী রঙের গা চাপা পোশাক, এবং প্যান্টের উপর লাল রঙের জাঙ্গিয়া, পিছনে লাল রঙের কাপড় উড়ছে... 

প্রথম দর্শনেই প্রেম... You will believe a man can fly !!!! প্রতি সপ্তাহে ১-২ করে কমিকস আসছে, গোগ্রাসে গিলছি, আহঃ ... এই তো জীবন কালী দা!!! 

 

৬ বছর বয়সে বাঁধানো কমিকসের বই নিয়ে প্রথমবার মেজমাশির বাড়িতে দু দিন থাকতে গেলাম। 

মেসো আমার হাতে বাঁধানো বই দেখে অবাক হলো,আরো অবাক হলো যখন দেখলো আমি কি যত্ন করে পড়ছি, খুব খুশি হয়ে বললো - ওটা তো তোর পড়া বই, আবার পড়ছিস, ভালো লাগছে ?? বাচ্চা আমি বলে উঠি, আবার সামনের সপ্তাহে নতুন বই আসবে, সে গুলো পড়বো। 

মেসো হাত ধরে আমাকে নিয়ে এলো ছাদে। এর আগেও ওই বাড়ির ছাদে এসেছি, কিন্তু ছাদের ঘরে কোনদিনও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেদিন ঢুকলাম ... 

কোনও দেওয়াল খালি নেই.... যেদিকে দেখি, শুধু বই। 

একটা দেওয়ালের দিকে চোখ গেল। দেখি আমার নিয়ে আসা বাঁধানো বইটার মতন অজস্র বই। মেসোর দিকে তাকালাম , দেখি উনি হালকা হাসছেন.... এগিয়ে গিয়ে একটা বই বার করলাম .... ও মা !!! এ তো বেতাল .... আরো একটা !!! এটাও বেতাল... 

কমিকসের স্বর্গে প্রবেশ পেলাম। সেই শুরু.... পরের ১০ বছর শীতকালে ৫ দিন, গরমকালে ৫ দিন মাসির বাড়ি থাকা fixed হয়ে গেলো। 

দিন যায়, সেই কাকার হাত দিয়ে লাল চুলো এক টিনএজারের সঙ্গে আলাপ হলো, তার সঙ্গে তার খাদ্যরসিক , লম্বা নাকের টুপিওয়ালা বন্ধু এবং তাদের জীবনের সঙ্গে পরিচয় হলো।  

মাসতুতো দিদিকে airport থেকে আনতে গিয়ে , সেখানকার বইয়ের দোকানে গিয়ে ৮ টাকা দামের আর্চি ডাইজেস্ট তুলে নিয়েছিলাম ২৫ খানা। মাথায় গাট্টা মেরে ২৪ খানা সরিয়ে নিয়েছিলো আমার মাসী। ১৯৮৩ সালে ২০০ টাকার কমিকস কিনে দিলে, মাসীকে আমার মা খুন করে দিত !!! 

সেদিন রাগের মাথায় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম , পৃথিবীর সব কমিকস আমার কাছে থাকবে !!! 

উপর থেকে একজন সেদিন একটা ৭ বছরের বাচ্চার প্রতিজ্ঞা শুনতে পেয়েছিলেন। সেদিন যদি অন্য কিছু চাইতাম, ১০০ কোটি টাকা বা হলিউডের হিরো বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী , সেটাও হয়ে যেত !!! 

আজ আমার কাছে ১,০০,০০০ এর বেশি ডিজিটাল কমিকস আছে, টিনটিন, Asterix, নারায়ণ দেবনাথ, সম্পূর্ণ ইন্দ্রজাল কমিকসের বাঁধানো সেট আছে... ১০০০- এর বেশি আর্চি, ডিসি, মার্ভেল হার্ড কপি আছে....কিন্তু সেই ৭ বছরের ছেলেটার হাতে সেগুলো তুলে দেওয়া হয়নি.... 

যাই হোক... দিন কেটে যাচ্ছে, বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো, কাকু বাবাকে পথে বসিয়ে,আমার হাতে নন্টে ফন্টে ধরিয়ে দিয়ে, দুষ্টু লোক হয়ে গেলো (ভ্যানিশ) । অবাক পৃথিবী প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলো, ডিসির ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি বন্ধ হয়ে গেলো... ইন্দ্রজালের দাম বেড়ে গেলো, আমার সাপ্লাই কমে গেলো। একমাত্র বছরে ২ বার মাসির বাড়ি গেলেই নতুন কমিকস পড়তে পারতাম... মাঝে, মাঝে কেউ যদি কোনো কমিকস উপহার দিতো, তবেই কিছু পড়া হতো। স্কুলের বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে পড়তাম...

১৬ বছর বয়সের পরে, লেখা পড়ার চাপ বেড়ে গেলো। ততদিনে ইন্দ্রজালও বন্ধ হয়ে গেলো, মাসির বাড়ি গিয়ে থাকা ঘুচে গেলো। ১৮ বছরে পড়ার জন্যে বঙ্গদেশ ছাড়লাম। ৬ মাস পরে বাড়ি ফিরে দেখি, উই আর ইদুরে আমার সব বই ধ্বংস করে দিয়েছে !!!!

কাকে দোষ দেবো?? বাবা জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন। মা আমার ১৬ বছর বয়সে, সংসার বাঁচানোর জন্যে চাকরি করতে ঢুকলেন ৪০ কিমি দূরে একটি অফিসে।  

সংসার চালাতে গিয়ে বইয়ের দিকে আর কি করে নজর যাবে ??? পোকায় এবং ইদুরে কাটা বই গুলো হাতে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা বসে ছিলাম। 

কলেজের ৪ বছর আমার সাথী ছিলো পুজোবার্ষিকী গুলো... শীতের ছুটিতে এসে নিয়ে যেতাম পত্রিকা গুলো। ২২ বছর বয়সে চাকরি নিয়ে বোম্বে গেলাম। লোকাল ট্রেনের স্টেশনে আবার দেখলাম আর্চি কমিকস.... প্রথম মাইনে ৫৫০০ টাকা পেয়ে , আগে বাড়িওয়ালা কে ১৭০০ টাকা দিলাম, ১০০০ টাকা মাকে পাঠিয়ে দিয়ে, ৪০ টাকা দিয়ে আবার আর্চি কিনলাম। পরের ৩.৫ বছর ধরে ৩০/৩৫ খানা আর্চি আমার কাছে ফিরে আসার পরে, আবার সব কিছু ফেলে, আমাকে বিলেত যেতে হলো কর্মসূত্রে... বইগুলো আবার কলকাতায় পাঠিয়ে দিলাম। 

লিডস শহরে প্রথম দিন কাজ শুরু করে, লাঞ্চ করার জন্যে অফিসের নিচে একটা স্যান্ডউইচের দোকানে ঢুকতে যাওয়ার মুখেই দেখি, একটা দোকানে একজন চেনা মুখের ছবি.... সেই স্মিত হাসি, সেই কোকড়ানো চুল, সেই লাল জাঙ্গিয়া.... লাঞ্চ না করে ঢুকে গেলাম "Mid town Comics Shop" এ.... 

কমিকসের জন্যে স্পেশালিস্ট দোকান !? ভাবা যায়... সেদিনই কিনে ফেললাম Death of Superman এবং Amazing Spider-Man এর প্রথম ১০০টা সংখ্যার black and white reprint 

পরের ২ বছরে যা কমিকস কিনেছিলাম, দেশে ফিরে আসার সময় ১৭০ পাউন্ড দিয়ে কুরিয়ার করে এনেছিলাম। দেশে ফিরে দেখি ডিসি আর মার্ভেল আবার নতুন করে প্রকাশিত হচ্ছে, এবং যথেষ্ট সস্তায় প্রকাশিত করছে গোথাম কমিকস। 

২০০৫ এ আবার বিলেত গেলাম দুই মাসের জন্যে, এবং প্রথমবারের জন্যে পেলাম ডিজিটাল কমিকস। 

ফ্যান্টাস্টিক ফোরের সম্পূর্ন ৪৫০ খানা কমিকস, মার্ভেল থেকেই পিডিএফ করে ডিভিডিতে বিক্রি করছিলো.... ব্যাস , আমায় আর পায় কে !!! সস্তায় পুষ্টিকর, ডিজিটাল কমিকস আমার হাতের মুঠোয় চলে এলো।  

প্রথম প্রথম ল্যাপটপে পড়তাম, কিন্তু বসে বসে পড়তে ভালো লাগে না। শুয়ে পড়ে, ল্যাপটপটা বুকের উপর নিয়ে পড়তাম, কিন্তু স্ক্রিনটা চোখ থেকে অনেক দূরে, ভালো লাগতো না। 

২০০৯ এ শুনলাম, অ্যাপল কোম্পানি একটা স্ক্রীন সর্বস্ব ল্যাপটপ বার করবে, নাম দেবে আইপ্যাড। ২০১০ এ বাজারে এলো আইপ্যাড ১, যা দাম করেছিলো, বুক কেপে উঠলো শুনে। 

আবার উপর থেকে আমার দিকে একজন ফিরে তাকালেন, ২০১১ এ এলো আইপ্যাড ২, আর সেইবারই আমাদের অফিসে আমাদের একটা বোনাস পেলাম (সেই প্রথম, সেই শেষ) - একটা ১৬ জিবি আইপ্যাড এবং তার কভারের ব্যবস্থা হয়ে গেলো । 

শুধু ল্যাপটপ থেকে তার লাগিয়ে ঢোকানোর অপেক্ষা। আজ ১১ বছর হয়ে গেল, এখনও তার লাগাচ্ছি, ট্যাবলেটে ঢোকাচ্ছি আর পড়ছি। ... কালীদা !!! এই জীবনই তো চেয়েছি.... 

মেসোর অবর্তমানে মাসী সব কটা বাঁধানো কমিকস আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। মা রিটায়ার করেছেন, এখন আমার বইগুলোকে গুছিয়ে রাখছেন। বাবা জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে আগের মানুষটার একটা ছায়া হয়ে বেঁচে আছেন। আমি দেশেই প্রবাসী হয়ে ভাবছি, কি করে একটা ঘর বানিয়ে কলকাতা থেকে আমার বইগুলোকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। 

 যা বই হারিয়েছিলাম, সব ফিরে পেয়েছি সুদে-আসলে। ট্যাবলেটে কমিকস পড়বার মজাটা নেওয়ার চেষ্টা করি। যা যা চেয়েছি, সব না হলেও অনেক কিছুই পেয়েছি, কিন্তু সেই ৭ বছরের ছেলেটার হাত থেকে যে ২৪ খানা বই নামিয়ে নেওয়া হয়েছিলো, সেগুলো আর সে পেলনা ....

মিড-লাইফ ক্রাইসিস

 

©সৌভিক বসু 

আমার বয়সটা ভালো নয়। বিশিষ্ট লেখক কৌশিক মজুমদার বাবু বলেছেন যে এই বয়সটা নাকি মধ্য বয়সের টিনএজ !!! মানে আমি যুবকও নই, আবার বৃদ্ধও নই... মানে Dhobi ka kutta, na Ghar ka na ghaat ka ... ছেলে ছোকরাদের সাথে মিশতে গেলে, কাকু বলে কাটিয়ে দেয়। বুড়োদের সাথে মিশতে গেলে, তারা বিশেষ পাত্তা ফাত্তা দেয় না... সমবয়স্ক-রা আলোচনা করে বসের খিস্তি, ছেলের পরীক্ষা, মেয়ের টিউশন, বউয়ের পেট খারাপ, শেয়ার মার্কেট, জয়শ্রীর আম আর ... মানে, ওই আর কি ...

বয়ঃসন্ধিকালের কথা মনে পড়ে যায়, জানেন ???

বাচ্চাদের সাথে খেলা যেত না, দাদারা পাত্তা দিতো না, সমবয়স্ক-রা আলোচনা করতো অঙ্ক স্যারের খিস্তি, ক্লাসের পরীক্ষা, ফিজিক্স স্যারের টিউশন, বাবার ধোলাই, সচিনের সেঞ্চুরি আর পাশের পাড়ার জয়শ্রীর সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে... টুকি টুকি খেলা ..

আপনারা কি ভাবলেন ?? 

সে যাই হোক , মানে এখন বয়সটা খুব সুবিধার নয়, মধ্যে বয়সে পা দিয়েছি, যাকে বলে মিড লাইফ ...

এখন মিড লাইফ এসেছে, ক্রাইসিস আসবে না, সেটা কি হয় ??

আমারও এলো ... 

গতকাল সকালে উঠে মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল... বাইরে চড়চড় করছে রোদ, আমি বুঝতে পারছি আমার প্রেশার-টাও বাড়ছে ... শরীরের কথা ভেবে জলখাবারে শুধুমাত্র ফল খেলাম ... মনটা হু-হু করে উঠলো.... মোবাইলটা হাতে নিলাম খুটুর খুটুর করবো বলে, ভালো লাগলো না ...

ট্যাবলেট নিলাম কমিকস পড়বো বলে, দু পাতা পড়ে রেখে দিলাম...

বই নিলাম, ভালো লাগলো না...

সব বন্ধ করে দিয়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে আরম্ভ করলাম ....

কি করেছি জীবনে ? কি করছি জীবনে ? কি করবো জীবনে ??

কেন করেছি ? কেন করছি ? কেন করবো ?

তারপর ভাবলাম - কেন ভাবছি এই সব ? এটাকেই কি মিড-লাইফ ক্রাইসিস বলে ?

বউকে জিজ্ঞাসা করলাম... সে বলে - আদিখ্যেতা হচ্ছে ?? যদি মিড লাইফ ক্রাইসিস হয়, যাও তাহলে গিয়ে একটা পরকীয়া করে এসো অন্য লোকের মতন ...

আবার ভাবতে বসলাম , সত্যিই কি একটা পরকীয়া করলে মন ঠিক হবে ?? ভেবে দেখলাম, প্রচুর চাপ ... ভুঁড়ি কমাতে হবে, ফেসিয়াল করতে হবে, নতুন জামা কিনতে হবে, guilty conscience ঢাকার জন্যে বউকে মাঝে মাঝে দামী গিফট দিতে হবে, গার্ল ফ্রেন্ড কে ঘোরানোর জন্যে বাইক বা গাড়ি কিনতে হবে, তার আগে অবশ্য বাইক চালানো আর গাড়ি চালানো শিখতে হবে ... প্রচুর চাপ, প্রচুর খরচ !!! আর জানাজানি হলে শ্বশুরের কাছে মারধোর খাওয়ার কথা ভুললে চলবে না !! উনি এই বয়সেও 20 কেজি চালের বস্তা উঠিয়ে নেন, আমাকে রামপাট ক্যালাতে বেশি কষ্ট হবে না...

তারপর ভেবে দেখলাম, ও সব তো পরের কথা, আগে আমাকে সোফা থেকে উঠে বাইরে যেতে হবে...

অত চাপ নিয়ে আর যাই হোক না কেন, পরকীয়া করতে পারবো না...

কিন্তু তাহলে মিড লাইফ ক্রাইসিস কি করে দুর করবো ?? 

এই ভাবতে ভাবতে দুটো বেজে গেলো, কমোড সাফ করতে হবে ভুলেই গেছিলাম, বউয়ের ধাতানি খেয়ে, কমোড সাফ করে স্নান করে নিলাম ...

ভাবা তবুও থামছে না... এদিকে মনটা সেই খারাপ হয়েই আছে, খিদেও পাচ্ছে ...

মিড লাইফ ক্রাইসিস কি ভাবে হ্যান্ডেল করবো ?? এই ভাবতে ভাবতে খাওয়ার টেবিলে বসে গেলাম ....

এক প্লেট মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ খেয়ে উঠে ভাবতে বসলাম .... দুপুরে এবার কি ঘুমোবো না কি সিনেমা দেখবো ??

ক্রাইসিস ?? কিসের ক্রাইসিস ?? পেটে ভালো ভালো জিনিস পড়লে তখন আর কোনো ক্রাইসিস থাকে না ... সবই মধু ... মিড লাইফ ক্রাইসিস কাটাবার ওষুধ পেয়ে গেছি !!!